শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভুল স্বীকারের অভ্যাস

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষ হিসেবে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে চান। পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক কাজকর্ম ও পেশাগত ক্ষেত্রসহ সর্বত্র দক্ষতার প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। এটা অর্জনের অন্যতম পদ্ধতি হলো সাবলীলভাবে সত্যপথ অবলম্বন করা। মিথ্যা বর্জন করে ভুলত্রুটি স্বীকারের মানসিকতা গড়ে তোলা।

সম্মিলিত কাজের ক্ষেত্রে সবেচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় হলো নিজের কোনো ভুল স্বীকার না করা। নিজের দোষকে ইনিয়ে-বিনিয়ে, ছলে-বলে কিংবা কৌশলে অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া। এমন অভ্যাস কোনো আদর্শ সহকর্মী কিংবা নাগরিকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। অতএব কোনো ভুল হলে তা সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করা। ভুল শুধরে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটা অন্যের নিকট গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার কারণও বটে। চলার পথে মানুষেরই ভুল হয়, কেউ যখন ভুল বুঝতে পারে তা শুধরে নেয়।

আবার কেউ নিজের ভুলের ওপর গোঁ ধরে বসে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, ভুল স্বীকার করা ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী। এ কারণে সম্মানহানি ঘটবে। অথচ বিষয়টি এমন নয়। মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। আর মহৎ গুণগুলোর একটি হচ্ছে কৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া। ভুল করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গোনাহগার। আর গোনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরা উত্তম।’ সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৫১

কোনো কিছুর শুরুর দিকে মানুষের দুর্বলতা থাকে, ভুল থাকে। ভুল থেকেই শিখতে হয়। আপনি হয়তো কোথাও বক্তৃতা দিয়েছেন, একটু ভুল হয়েছে। এ কারণে লোকেরা হাসতে পারে, কটু কথা বলতে পারে এসব নিয়ে মন খারাপ করলে চলবে না। বরং খেয়াল রাখতে হবে, আপনার আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় যেন ন্যূনতম অহংকার কিংবা কোনো ধরনের জেদ প্রকাশ না পায়।

ভুল হয়ে গেলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার চমৎকার উদাহরণ রেখে গেছেন রাসুলের প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর মধ্যে বিতর্ক হলো, হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কোনো কথায় হজরত ওমর (রা.) রাগান্বিত হন এবং রাগান্বিত অবস্থায় হজরত ওমর (রা.) সেখান থেকে চলে যান। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে তার পিছু নিলেন, কিন্তু হজরত ওমর (রা.) ক্ষমা করলেন না, বরং তার সম্মুখের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এরপর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এলেন। হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, আমরা তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে (বসা) ছিলাম, ঘটনা শোনার পর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের এই সঙ্গী আবু বকর আগে কল্যাণ লাভ করেছে। তিনি বলেন, এতে ওমর লজ্জিত হলেন এবং সালাম করে নবী (সা.)-এর পাশে বসে পড়েন। সব কথা রাসুল (সা.)-এর কাছে বর্ণনা করেন। হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, এতে রাসুল (সা.) অসন্তুষ্ট হলেন। আর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি বেশি দোষী ছিলাম।

পুনরায় রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আমার খাতিরে আমার সাথির ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? তোমরা আমার খাতিরে আমার সঙ্গীর ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? এমন একদিন ছিল যখন আমি বলেছিলাম, হে লোক সকল! আমি তোমাদের সকলের জন্য রাসুল, তখন তোমরা বলেছিলে, তুমি মিথ্যা বলেছ আর আবু বকর (রা.) বলেছিল, আপনি সত্য বলেছেন। সহিহ বোখারি : ৪৬৪০

‘আমি ভুল করেছি, আশা করি আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’ ‘নিজের অজান্তেই ভুলটি করে ফেলেছি, এমনটি আর হবে না।’ ‘ভুলের জন্য আমি লজ্জিত, আমার আরও সতর্ক থাকা দরকার ছিল।’

এই সামান্য কথায়, লুকিয়ে থাকা সব ক্ষোভ রফা করে দিতে পারে মুহূর্তেই। কিন্তু সমাজে ভুল স্বীকার করার মানুষ খুব কম। অথচ এই অনুশোচনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই ভুল হলে আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা। এতে দুর্বলতা নয়, উদারতা প্রকাশ পায়।

ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো ভুল স্বীকার এবং অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া। আর এর দায়ভার মেনে নেওয়া। কোনো মাধ্যম ব্যতীত যার সঙ্গে ভুল হয়েছে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করা। প্রকাশ্যে ভুল করলে প্রকাশ্যে অনুতপ্ত হওয়া। কারও প্রতি দায়ভার না চাপিয়ে নিজেই সব মেনে নেওয়া। নিজের ভুল স্বীকার করতে গিয়ে আকার-ইঙ্গিতে কাউকে দোষারোপ না করা।

ভুল যদি নিজের অজান্তে হয়ে থাকে তাহলেও তা মানুষের সামনে স্পষ্ট করা। এর দ্বারা কখনো সম্মানহানি ঘটে না। তবে বারবার একই ভুল করা থেকে পূর্ণ সতর্ক থাকা, নয়তো এ কারণে মানুষের মধ্যে আপনার ওজন কমে যাবে। আপনি হয়ে উঠবেন হাসির পাত্র।

কৃত ভুলের কারণে যদি কোনো সংকট তৈরি হয়, তা মেনে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা। এ ক্ষেত্রে কোনো তিরস্কারের সম্মুখীন হলে ধৈর্য ধারণ করা। এ বিষয়ে অহেতুক তর্কে না জড়ানো, বরং অনুশোচনা প্রকাশ করা।

ভুল স্বীকার করা নবীদের বৈশিষ্ট্য ছিল। অথচ তারা ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, ভুল স্বীকার মানুষের মর্যাদাকে ছোট করে না।

প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম (আ.) ভুল স্বীকার করে তওবা করেছেন, তওবা করেছেন হজরত মুসা (আ.)। লেখার শুরুতে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, নবী কারিম (সা.) নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক সত্তরবারের বেশি তওবা-ইস্তেগফার করেছেন। এসব ঘটনায় রয়েছে উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক।

muftianaet@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION